বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:৪২ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুইবার ভোটার হওয়া এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করায় তার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন ইসি সচিব মো. আলমগীর। সাবরিনা মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজের নামে দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়েছেন বলে জানতে পেরেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুটি আইডিতে বয়সের পার্থক্যও দেখানো হয়েছে। বর্তমানে তার দুটি এনআইডিই সক্রিয়। দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টি টের পাওয়ার পর বিস্তারিত জানতে ইসির কাছে তথ্য দিয়েছে। ইসি বিষয়টি তদন্ত করছে।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর বলেন, এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালককে মামলা করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সাবরিনার দ্বিতীয় এনআইডিটি ব্লক করে দেওয়া হয়েছে।
ইসি সচিব জানান, কোন প্রক্রিয়ায়, কার সুপারিশে তিনি দ্বিতীয়বার ভোটার হয়েছেন, আমাদের কেউ কোন অসৎ উদ্দেশ্যে সহায়তা করেছেন কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ভোটার তালিকা আইন-২০০৯ অনুযায়ী, দ্বৈত ভোটার হওয়া বা চেষ্টার বিষয়টিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্তত দুই বছর জেল ও জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
মো. আলমগীর বলেন, আমরা ইতিমধ্যে দুদকের চিঠি পেয়েছি। জাতীয় পরিচয়পত্রের বিষয়টি দেখে কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ। আমরা সেই বিভাগকে চিঠির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানাতে বলেছি। তারা প্রতিবেদন জমা দেবে। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানাতে পারবো। এর আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। দ্বৈত ভোটারের বিষয়টি প্রমাণিত হলে এবং এর সঙ্গে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে মৌখিকভাবে নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট থানা নির্বাচন কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে। এরপরও আমরা একটা চিঠি দিচ্ছি মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করার জন্য।
সূত্রমতে, প্রতারক সাবরিনা ২০১৬ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় দ্বিতীয়বার ভোটার হন। একটিতে সাবরিনা শারমিন হোসেন নাম দিয়ে ভোটার হন। এতে জন্ম তারিখ ১৯৭৮ সালের ২রা ডিসেম্বর দেখানো হয়। অন্যটিতে ১৯৮৩ সালের ২রা ডিসেম্বর। দুটি আইডিতে বয়সের তফাত অন্তত পাঁচ বছর। একটিতে স্বামীর নাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন আর এইচ হক। দ্বিতীয়টিতে স্বামীর নাম লেখা হয়েছে আরিফুল চৌধুরী। একটিতে বাবার নাম সৈয়দ মুশাররফ হোসেন ও মায়ের নাম কিশোয়ার জেসমীন। অপরটিতে মা-বাবার নাম পরিবর্তন করে সৈয়দ মুশাররফ হুসেন ও জেসমিন হুসেন দিয়েছেন। দুই এনআইডিতে দুই ঠিকানাও ব্যবহার করেছেন তিনি। একটিতে মোহাম্মদপুরের পিসিকালচার হাউজিং সোসাইটির ঠিকানা অন্যটিতে বাড্ডা এলাকার প্রগতি সরণির আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে।
এদিকে ইসির এনআইডি শাখা থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সালে প্রথমবার ভোটার হন সাবরিনা শারমিন হোসেন। সেই অনুযায়ী তার এনআইডি নম্বর: ৬৪৪০০৮৩৮৩৭। ভোটার নম্বর: ২৬১৩০১০০০০২৫। বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা: ১২২/ক, মোহাম্মদপুর পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটি। জন্ম তারিখ: ২ ডিসেম্বর, ১৯৭৮। মাতার নাম: কিশোয়ারা জেসমিন, স্বামীর নাম: এইচ হক। পেশা: সরকারি চাকরি আর শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্নাতকোত্তর।
অন্যদিকে তথ্য গোপন এবং মিথ্য তথ্য দিয়ে ২০১৬ সালে পুনরায় ভোটার হয়েছে সাবরিনা শারমিন হোসেন। সিই অনুযায়ী, তার অপর এনআইডি নম্বর: ৮৭০৪৩৭৩০৮৬। ভোটার নম্বর: ২৬১১১৫৫০০২৩২৫। বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা: ১৪/এ, আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক, প্রগতি সরণি, বাড্ডা।
এই এনআইডিতে তার জন্ম তারিখ: ২ ডিসেম্বর, ১৯৮৩। অর্থাৎ ৫ বছর বয়স কমিয়েছেন তিনি। মায়ের নাম জেসমিন হোসেন আর স্বামী আরিফুল চৌধুরী। মায়ের ও স্বামীর নামে পরিবর্তন হয়েছে। এছাড়া শিক্ষাগত যোগ্যতা কমিয়ে স্নাতক উল্লেখ করা হয়েছে। আগের এনআইডিতে শনাক্তকারী কোনো চিহ্ন না থাকলেও দ্বিতীয় এনআইডিতে ‘চিবুকে তিল’ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এনআইডি মহাপরিচালক বলেন, আমরা অতীতেও অনেকের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়ার কারণে মামলা দিয়েছি। কাউকেই ছাড় দেইনি। এ ঘটনায় জড়িতদেরও ছাড় দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে ১৫ জুন কামাল হোসেন নামে এক ব্যাক্তি তেজগাঁও থানায় মামলা করেন। ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে দুপুরের সাবরিনা ও আরিফসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিটটি দাখিল করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। চার্জশিটে সাবরিনা ও আরিফকে মূল হোতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকিরা প্রতারণা ও জালিয়াতি করতে তাদের সহযোগিতা করেছে।
২৩ জুন (মঙ্গলবার) জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ। এরপর একে একে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। জানা যায়, জেকেজি হেলথ কেয়ারের কোনো ল্যাব বা পরীক্ষাগার ছিলো না। কম্পিউটারে ফলাফল লিখে ই-মেইলে তা রোগীর কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
সূত্রমতে, জেকেজি নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনার টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করেছে। একটি ল্যাপটপ থেকে গুলশানে তাদের অফিসের ১৫ তলার ফ্লোর থেকে এই মনগড়া করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের মেইলে পাঠায় তারা। তাদের কার্যালয় থেকে জব্দ ল্যাপটপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর করোনা টেস্ট জালিয়াতির এমন চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে।
জানা যায়, জেকেজির টেস্টে জনপ্রতি নেয়া হতো সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। বিদেশি নাগরিকদের কাছে জনপ্রতি এক শ ডলার। এ হিসাবে করোনার টেস্ট বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা। করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন নিয়ে এমন নির্মম বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত জেকেজির চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী প্রতারক আরিফ চৌধুরী।
আরিফুল হক চৌধুরী গ্রেপ্তারের পর থেকেই অভিযোগ ওঠে তার স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জেকেজির সার্বিক কাজে শুরু থেকে তাকে সহায়তা করে আসছিলেন। সাবরিনা নিজে জানিয়েছেন তিনি তিতুমীরের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন যারা কিনা গ্রেপ্তার আতঙ্কে কলেজ ছেড়ে পালিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে ভুয়া পরীক্ষা সনদ দিতেন এসব কথিত স্বেচ্ছাসেবীরাও। আর তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সাবরিনা আরিফ। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে প্রশাসন।
এ বিষয়ে ২৫ জুন বনানী থানার ওসি নুরে আজম মিয়া বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, জেকেজির কর্মীরা পালিয়ে গিয়েছে বলে আমরা শুনেছি। তবে, তারা ভুয়া রিপোর্ট দিতো কিনা সে বিষয়টি আমাদের জানা নেই। বিস্তারিত তদন্তের পর জানা যাবে।
২৩ জুন (মঙ্গলবার) জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ। তখন জেকেজি হেলথ কেয়ারের অন্যতম কর্ণধার হিসেবে আরিফুল চৌধুরীর স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফের নাম এলেও তিনি দাবি করছেন, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত দুই মাস ধরে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, আমাকে জড়িত করা হবে কেনো? আমি তো অনেকদিন ধরেই এর সাথে নেই।
তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠানের শুরুর দিক থেকেই জড়িত ছিলেন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তিতুমীর কলেজে নিজেদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ব্যবহারের সময় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় নিজের এই পরিচয় প্রকাশ করেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের এমডি আরিফুল চৌধুরী তার স্বামী।
জানা যায়, জেকেজি হেলথকেয়ারের অনুমতি পাওয়া থেকে শুরু করে এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত এই চিকিৎসক। এ বিষয়ে খোদ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নানা রকম অভিযোগ করেছেন।
তিতুমীর কলেজের হামলার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডা. সাবরিনা আরিফ। তিনি তখন গণমাধ্যমেও বক্তব্য দিয়েছিলেন। গভীর রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে কথিত হামলার বিচার চেয়েছিলেন সাবরিনা। সে ঘটনা ঘটে এ মাসের শুরুর দিকে। তার দাবি তিনি গত দুইমাস ধরে এর সাথে সংশ্লিষ্ট নেই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কার্ডিয়াক সার্জন ও ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর উদ্যোগেই মূলত জেকেজি হেলথকেয়ার বুথ স্থাপনের কাজ পায়। তবে পরবর্তীতে তাদের সম্পর্ক নিয়ে আরিফুল চৌধুরী আপত্তি জানালে সেখানেই শুরু হয় টানাপোড়েন। আর এসব বিষয়ে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেই একাধিক অভিযোগ যায়।
Leave a Reply